আনোয়ার হোসেন, মণিরামপুর (যশোর): সত্যজিৎ বিশ্বাসের বাড়ি মণিরাপুরের কুচলিয়া গ্রামে। শিক্ষকতা করেন জেলার অভয়নগরের ধোপাদী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। পড়ান নবম ও দশম শ্রেণির গণিত, সাধারণ বিজ্ঞান এবং পদার্থ বিজ্ঞান। একজন সাধারণ শিক্ষক হয়েও কর্মগুণে অসাধারণ সত্যজিৎ। ৩৫ বছরের শিক্ষকতা জীবনে একদিনও অনুপস্থিত থাকেননি কর্মস্থলে। ঝড়বৃষ্টি কিংবা অসুস্থতা প্রতিবন্ধক হতে পারেনি তার পথে। এমনকী নিজের বিয়ে কিংবা বাবার মৃত্যুও না।
এই গুণের জন্য জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে এক ডজনের বেশি পুরস্কার পেয়েছেন সত্যজিৎ। আলোচিত হয়েছেন দেশজুড়ে। শিক্ষণ দক্ষতা দিয়ে জয় করেছেন অসংখ্য শিক্ষার্থীর মন।
গুণী এই মানুষটির কর্মজীবনের সমাপ্তি ঘটছে আগামী মাসের ৯ তারিখ। তিনি বিদ্যালয়ে থাকছেন না- এমনটি ভাবতেই স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। অবসর কীভাবে কাটাবেন, ভেবে পাচ্ছেন না নিজেও।
১৯৮৪ সালে বিএসসি পাশের মধ্য দিয়ে শিক্ষাজীবনের ইতি টানেন সত্যজিৎ বিশ্বাস। দুই বছর পর ১৯৮৬ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন ধোপাদী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। প্রতিজ্ঞা ধরে রাখতে এরপর থেকে একদিনও কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিত থাকেননি তিনি।
১৯৯০ সালে এক শুক্রবার রাতে নড়াইলের পঁচিশা গ্রামের আরতী বিশ্বাসকে বিয়ে করেন সত্যজিৎ। বিয়ের অর্ধেক কাজ সেরে নববধূকে রেখে শনিবার সকালে ২০ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে সময়মতো স্কুলে যান। বিকেলে ছুটির পর আবার ২০ কিমি পাড়ি দিয়ে শ্বশুরবাড়ি গিয়ে বিয়ের বাকি কাজ সম্পন্ন করেন।
১৯৯৩ সালে কোনো এক সোমবার সকালে বার্ধক্যজনিত কারণে মারা যান তার বাবা মাধবচন্দ্র বিশ্বাস। তখন পাড়ার লোকজন ডেকে তিনি নিজের প্রতিজ্ঞার কথা বলেন। এরপর যোগ দেন ক্লাসে। বিকেলে স্কুল ছুটির পর বাবার সৎকার করেন।
একই প্রতিষ্ঠানে পদন্নোতি পেয়ে ২০১৫ সালে সহকারী প্রধান শিক্ষক হন সত্যজিৎ। সহকারী প্রধান শিক্ষক হয়েও নিয়মিত নবম ও দশম শ্রেণির গণিত, সাধারণ বিজ্ঞান এবং পদার্থবিজ্ঞান পড়ান।
বুধবার (২৯ সেপ্টেম্বর) সকালে সরেজমিন ধোপাদী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শ্রেণিকক্ষে পাওয়া যায় তাকে। তখন স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এসব কথা বলেন গুণী এই মানুষটি।
কর্মক্ষেত্রে তিনি যেমন সফল, তেমনি পরিবার প্রধান হিসেবেও। এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক তিনি। ছেলে কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিসংখ্যানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে চাকরির অপেক্ষায়। মেয়ে পশুপালনের ওপর স্নাতকোত্তর করছেন ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। আর স্ত্রী আরতী বিশ্বাস গৃহিণী।
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সত্যজিৎ বিশ্বাস বলেন, ‘কর্মজীবনে যোগ দেওয়ার সময় প্রতিজ্ঞা করেছিলাম জীবনে কোনোদিন স্কুল ফাঁকি দেবো না। বিধাতা আমাকে এই কাজে সাহায্য করেছেন। বড় ধরনের অসুখও হয়নি। সবসময় ঠিকমতো হাজির হয়েছি স্কুলে। চাকরিজীবন দুইদিন স্কুলে পৌঁছানোর পর কিছুটা অসুস্থবোধ করি। একদিন ক্লাস শুরুর আগে সমাবেশ চলা অবস্থায় মাথাঘুরে পড়ে যাই। সবাই মিলে আমাকে ধরে অফিসকক্ষে নিয়ে মাথায় পানি দেন। এরপরই আমি সুস্থ হয়ে যাই।’
‘ছোটবেলা থেকে আমি এমন। গ্রামের দিগঙ্গা কুচলিয়া হরিদাসকাটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। স্কুলজীবনে অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে কোনোদিন অনুপস্থিত থাকিনি। অসুস্থতার জন্য দশম শ্রেণিতে দুই দিন অনুপস্থিত ছিলাম।’
তিনি বলেন, ‘প্রথমদিকে স্ত্রী একটুআধটু রাগ করতেন। এরপর আমার দেশসেরা শিক্ষক হওয়ার খবর জানলো। ২০১৯ সালে ডেইলি স্টার পত্রিকা থেকে আমাকে পুরস্কার দিলো। স্বামী-স্ত্রী দু-জনে বিমানে ঢাকায় গেলাম। তারপর থেকে তিনি নিজেও খুশি।’
অবসর জীবন কীভাবে কাটাবেন- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘বাড়ি বসে কর্মজীবনের কথা ভাবা ছাড়া গতি নেই। আমার গ্রামের মানুষও ঠিকভাবে আমাকে চেনে না। মণিরামপুর উপজেলায় বাড়ি হলেও আমার সব পরিচিতি স্কুলকে ঘিরেই।’
ধোপাদী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী সাদিয়া খাতুন বলে, ‘স্যার আমাদের গণিত পড়ান। কোনো সময় আমাদের উপর রাগ করেন না। না বুঝলে বারবার বুঝিয়ে দেন। স্যারকে পেয়ে আমরা গর্বিত। স্যার আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন- এটা ভাবতে কষ্ট হচ্ছে।’
মণিরাপুরের হরিদাসকাটি ইউনিয়নের কুচলিয়া ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য প্রণব বিশ্বাস বলেন, ‘সত্যজিৎ সম্পর্কে আমার ভাই। শিক্ষকতা নিয়ে ভাবতে গিয়ে গ্রামবাসীর সাথে মেশার সুযোগ পাননি। শিক্ষক হিসেবে তিনি আদর্শ।’
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘১৯৯০ সাল প্রধান শিক্ষক হিসেবে আমি এখানে যোগ দিই। সেই থেকে সত্যজিৎ বিশ্বাস আমরা সহকর্মী। কোনোদিন দেখিনি ঝড়-বৃষ্টি বা অসুস্থতার কথা বলে তাকে ছুটি নিতে। ঐচ্ছিক ছুটিও কাটাননি। ২০১৫ সালে সত্যজিৎ বিশ্বাসকে সহকারী প্রধান হিসেবে পেয়েছি। সার্বিক কাজে তিনি আমাকে সহযোগিতা করেন।’
নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আগামী মাসের ৯ তারিখ সত্যজিৎ বিশ্বাসের কর্মজীবনের শেষদিন। তাকে ছাড়তে হবে ভেবে খারাপ লাগছে। তারপরও তাকে সম্মানের সাথে বিদায় জানাতে চাই। আমি তার কল্যাণ কামনা করি।’